বিগত ১৭ই ডিসেম্বর ২০২০ ইং তারিখে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) "তৈরি পোশাকখাতে করোনা ভাইরাস উদ্ভুত সংকট সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়" শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা গবেষণা প্রতিবেদন হিসেবে দাবী করা হলেও এটি গবেষণার নুন্যতম মানদন্ড ও ন্যায়নীতি অনুসরণ করে করা হয়েছে বলে প্রতিয়মান হয় না বরং এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে টিআইবি তার নিজ সুনাম ক্ষুন্ন করেছে এবং গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। শিল্পকে ঘিরে এহেন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কোন শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। এ সকল কর্মকান্ডের পেছনে কোন দূরভীসন্ধী আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। টিআইবি’র ২৮ পৃষ্ঠায় পূর্নাঙ্গ প্রতিবেদন পর্যালোচনা পূর্বক আমাদের মূল্যায়ন নিম্নরূপঃ
১। গবেষণা পদ্ধতিঃ
প্রতিবেদনের ১ম পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, এটি গুণগত (Qualitative) গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেছ, এরূপ স্পর্শকাতর বিষয়ে এধরনের গবেষনা পদ্ধতি অনুসরণের ফলে যে ধরনের বিভ্রাট তৈরি হয়েছে তা হলঃ
ক। তথ্য সূত্র ও তথ্য নির্বাচন, তথ্যের বিশ্লেষণে গবেষকের পক্ষপাতিত্ব।
খ। বিভ্রান্তিকর উপসংহার যা ঢালাওভাবে সমগ্র শিল্পের উপর টানা হয়েছে।
গ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসকল উৎস হতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তা পুন:মূল্যায়ন হয়নি বরং এসকল উৎস হতে প্রাপ্ত তথ্য কতটা সম্পূর্ণ, হালনাগাদ, সঠিক ও পক্ষপাতহীন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কোন পন্থায় (লিখিত/মৌখিক) তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে সেটি উল্লেখ করা হয়নি, আবার প্রকাশের আগে কোন প্রকার আলোচনাও করা হয়নি। এই উপস্থাপনগুলো সঠিক না ভুল সেবিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে যাচাই বাছাই করা হয়নি।
ঘ। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটিতে অস্পষ্টতার ছাপ স্পষ্ট ভাবে লক্ষণ জনীয় যেখানে “প্রায়”, “অধিকাংশ”, “অনেক ক্ষেত্রে”, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে” ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা পরিমাপ যোগ্য নয় এবং বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা দেয়। লে-অফ, ছাটাই, মজুরী না দেয়া, স্বাস্থ্য-সুরক্ষা গাইডলাইন অমান্য, ইত্যাদি গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে এধরনের অস্পষ্ট (vague) ও ঢালাও (generalized) অভিযোগ ও অপবাদ গবেষণার শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে। এবং সেই সাথে এধরনের অস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কোন প্রকার সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেটি স্বচ্ছতার সাথে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হয়। এধরনের গবেষণা বাস্তবিক অর্থে চাঞ্চল্য সৃষ্টিতে যতটা কার্যকর, ঠিক ততটাই অকার্যকর কাঙ্খিত পরিবর্তন আনতে। অতএব, এসকল মুখরোচক গবেষণার নামে প্রহসন, এবং অর্থ ও শ্রমের অপব্যবহার না করে শিল্পে সুশাসনের যদি কোন ঘাটতি থাকে তা সঠিক ও সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরলে তা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়ক হবে।
ঙ) প্রতিবেদনের “মুখবন্ধে” সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বলেছেন যে অন্যান্যদের মধ্যে ‘বায়ার জোটের প্রতিনিধিরা’ তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন, তবে ‘গবেষণা পদ্ধতিতে’ উল্লেখিত প্রত্যক্ষ উৎসের মধ্যে ‘বায়ার জোটের প্রতিনিধির’ কথা উল্লেখ নেই। এসকল অসামঞ্জস্যতা গবেষক ও সংস্থাটির উদাসীনতা ও খামখেয়ালির প্রমান দেয়।
চ। যখন সমস্যাটি হয়েছিল তখন প্রোঅ্যাকটিভ না হয়ে আজকে যখন প্রথম করোনার প্রবাহটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি এবং দ্বিতীয় প্রবাহের সামনা সামনি হয়েছি সেখানে যেটি হয়ে গেছে সেটির বিচার করা দুর্ভাগ্যজনক।
ছ। গবেষণায় তথ্য ও তার উৎস নির্বাচনে গবেষকদের পক্ষাবলম্বনের প্রমান পাওয়া যায়। যেমন- কিছু মিডিয়া রিপোর্টের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে এবং অনেক রিপোর্ট এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁরা ঠিক কতজনের সাক্ষাতকার নিয়েছেন, কিভাবে উত্তরদাতা নির্বাচন করেছেন, বিভিন্ন অংশীজনের মধ্যে সমসংখ্যক অংশগ্রহনকারী ছিলেন কিনা, কি ধরনের প্রশ্ন করেছেন, কোন তথ্যটি কোন সময়কালের, এ বিষয়গুলো স্পষ্টকরে উপস্থাপন করা হয়নি।
২। অপরিকল্পিতভাবে কারখানা খোলার অভিযোগঃ
“অপরিকল্পিতভাবে কারখানা খুলে দিয়ে সমালোচনার মুখে একই দিনে পুনরায় কারখানা বন্ধের ঘোষণার” কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ করা হয়েছে যে “বিশৃঙ্খলভবে কারখানা খোলা হয় যা ঐ সকল অঞ্চলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্ট করে”। এ বিষয়টিতে আমরা একাধিকবার গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছি, কিন্তু ব্যাখ্যাগুলো গবেষকদের কাছে প্রাধান্য পায়নি, তই পুনরায় উল্লেখ করা হলঃ
প্রথমতঃ কোভিড-১৯ সমগ্র মানবজাতিকে একটি অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের মুখোমুখি করেছে। আমরা এর সমূহ বিপর্যয় এড়াতে সরকার এবং অংশীজনের সাথে করনীয় নিয়ে আলোচনা করেছি, শিল্প ও শ্রমিকের কল্যান বিবেচনায় অপরাপর প্রেক্ষাপটে যেটি সঠিক সেই সিদ্ধান্তই আমরা মেনে নিয়েছি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে পদক্ষেপ নিতে।প্রায় ৯ মাস পর সে সকল সিদ্ধান্তের সমালোচনা নিতান্তই বেমানান। কারণ তখনকার প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন ছিল। মনে রাখতে হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিল্প বন্ধ করে দেয়ার নজির আমাদের ইতিহাসে নেই। ‘সবজান্তার’ মত বিজ্ঞ আমরা কেউ নই। কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত যখন ২৮ মার্চ নেয়া হয়েছিল টিআইবি তখন নিরবতা ভেঙ্গে কারখানা বন্ধ রাখা সম্পর্কে তাদের মতামত জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারত।
দ্বিতীয়তঃ সংক্রমন দমন করতে কারখানা এক সপ্তাহের জন্য ছুটি দেয়া হয়েছিল। তবে এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এই দুর্যোগের মধ্যে কিভাবে তাঁদের আবাসস্থল ত্যাগ করে অনত্র গেল এবং কেনইবা আমরা তাঁদের দেখলাম দলে দলে ঢাকায় ফিরতে। তখন টিআইবি’র মত সংস্থা শ্রমিকদের সচেতন করতে কেন কার্যকর ভূমিকা নিল না, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।
তৃতীয়তঃ এপ্রিলের শুরুতে শ্রমিকের ঢাকায় ফেরার সময়টি ছিল মজুরী প্রদানের সময়, যখন পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতিতে সকল শ্রমিকের বেতন প্রদানের বিষয়টি প্রবর্তিত ছিল না এবং সেসময় স্বাভাবিক প্রথায় মাসের প্রথম সপ্তাহেই শ্রমিকরা বেতন পেতেন। কোভিডের ভয়াবহতা সম্পর্কে যখন কোন পক্ষেরই যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল না, এর সম্পূর্ণ দায়ভার মালিক সংগঠনের উপর চাপিয়ে দেয়া অনুচিত।
চতুর্থতঃ বানিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম মন্ত্রণালয় ও বানিজ্য সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার অভিযোগ আনা হয়েছে, তবে সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলাগুলো কি কি সে সম্পর্কে কোন ধারনা পাওয়া যায়নি। ঘটনার আকস্মিকতায় সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন করতে হয়, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ৯ মাস অপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত গ্রহনের সুযোগ তখন ছিল না। তাই যেকোন মূল্যে শিল্প ও শ্রমিকের কল্যানে নেয়া সরকার ও শিল্পের পদক্ষেপের এহেন সমালোচনা যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য নয়।
পঞ্চমতঃ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, অঞ্চল ভেদে নির্দিষ্ট সংখ্যক কারখানা খোলার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলভাবে কারখানা খোলা হয়। বিশৃঙ্খলতার সুস্পষ্ট কোন তথ্য দেয়া হয়নি। এটি অনস্বীকার্য যে, একটি শ্রমঘন শিল্প হিসেবে পোশাক শিল্পের উৎপাদন কার্যে ফেরাটি ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং পদক্ষেপ, তবে উৎপাদন কর্ম সচল না হলে শিল্পের তথা ৪০ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানের উৎসটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে, সেই বিবেচনায় অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে ও নজরদাড়ির মধ্যে রেখে কারখানা খোলা হয়। পরম করুনাময়ের অশেষ রহমতে বিশাল শ্রমজীবি মানুষের এই শিল্পে তেমন কোন স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটেনি। পোশাক শিল্পের এই ঘুঁরে দাঁড়ানো সব মহলেই প্রশংসিত হয়। Center for Bangladesh Studies, UC Berkeley, ও BRAC বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ অনুযায়ী ৯৪% শ্রমিক বলেছে তারা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গাইডলাইনের বিষয়ে সচেতন, ৯১.৪২% শ্রমিক বলেছে কারখানা তাদের নতুন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। পোশাকখাতের মত এত সুশৃঙ্খলভাবে অন্য কোন শিল্পখাত খোলা হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। গাইডলাইন অনুসরণ করে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলেই শিল্পে সংক্রমনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
ষষ্ঠতঃ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে সচেতনতা বৃদ্ধির কোন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়নি, তবে বাস্তবতা হল মায়া ও কমনহেলথ এর সাথে আমরা টেলিমেডিসিন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সাপোর্ট দিচ্ছি এবং সচেতনতা কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সাথে আইএলও’র তত্ত্বাবধানে এবং আমাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় কোভিড সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান আছে। এছাড়াও আমাদের প্রবর্তিত হেলথ গাইডলাইনে প্রশিক্ষণের বিষয়টি সন্নিবেশিত আছে এবং এত বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এই গাইডলাইন মেনে কাজ করতে পারছে কারন তারা এই বিষয়টিতে সচেতন হতে পেরেছেন।
৩। লে-অফ সংক্রান্তঃ
সমগ্র প্রতিবেদনজুড়ে লে-অফ ও শ্রমিক ছাটাই সংক্রান্ত অসত্য তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
ক। “প্রাথমিক পর্যায়ে বহুসংখ্যক শ্রমিক” ও “পরবর্তীতে অল্প সংখ্যক শ্রমিক” ছাটাই করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে টিআইবি’র প্রতিবেদনের গুণগত মান। বহুসংখ্যক কিংবা অল্পসংখ্যক এর অর্থ কি, এবং শিল্পে মোট কর্মসংস্থান ও স্বাভাবিক সময়ে লে-অফের ঘটনার বিচারে করোনা পরিস্থিতিতে তার মাত্রা কি, এ বিষয়গুলোর কোন সুস্পষ্ট তথ্য ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ না দিয়েই ঢালাও অভিযোগের মাধ্যমে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরির অপচেষ্টা করা হয়েছে।
খ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০-৬৫ হাজার শ্রমিক ছাটাইয়ের কথা বলা হয়েছে, যা শিল্পে মোট কর্মসংস্থানের ঠিক কতঅংশ এবং করোনাপূর্ব সময়ে কারখানা বন্ধের চিত্রের সাথে তুলনা করলে বিষয়টিকে কতটা অস্বাভাবিক বলা যায়, অথবা নিতান্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইনানুগভাবে লে-অফের বিষয়টিকে অপরাধ সাব্যস্ত করার প্রবণতা কিভাবে শিল্প ও অর্থনীতিকে সাপোর্ট করে তা বোধগম্য নয়। আইনের পরিধির মধ্যে থেকে শিল্প পরিচালনা করলেও যদি সুশাসনের ঘাটতি হয়, তবে টিআইবিকে সুশাসনের সংজ্ঞা পরিস্কার করতে হবে।
গ। প্রণোদনা পাওয়ার পর লে-অফ বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আমরা লে-অফ প্রত্যাশা করি না কারন আমরা শিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির পক্ষে। তবে আইনানুগ লে-অফ অবৈধ নয়। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে Furlough বৈধ করা হয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে আইন মেনে কারখানা লে-অফ করার সমালোচনা বেমানান, বিশেষ করে টিআইবি’র প্রতিবেদন যখন ভারত ও পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের প্রশংসা করছে (পৃষ্ঠা-১২), তখন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে শ্রম আইনের বিভন্ন ধারা সাময়িকভাবে রহিত করার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া তাদের চরম একপেশে ও পক্ষপাতিত্বের প্রমান দেয়।
ঘ। “বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের বাধ্যবাধকতার” বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল ব্যখ্যা করা হয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যের মাধ্যমে শ্রমিকদের মধ্যে যদি আতঙ্ক তৈরি হয়ে থাকে, তবে টিআইবি’র এই প্রতিবেদন সচেতন শ্রমিকরা পাঠ করে হাজার হাজার শ্রমিকের লে-অফ ও ছাঁটাইয়ের তথ্য, ৩,০০০ কারখানার ১৫ লক্ষ শ্রমিকের বেতন ভাতা অনিশ্চিত এবং ৩০%-৪০% ওয়েজ গ্যাপের তথ্য লাভ করে কী ধরনের ভীতির মুখোমুখি হতে পারে, কী ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে এবং শিল্প সম্পর্কে কী রকম বিরূপ মনোভাব তৈরি হতে পারে সে সমীকরণটি দূর্বোধ্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের আশংকা এধরনের দূরভিসন্ধি নিয়েই এধরনের গবেষণা কার্যকলাপ পরিচালিত হয়েছে। নতুবা এধরনের অস্পষ্ট ও অসময়োপোযোগী গবেষণার কোন কার্যকারিতা নেই।
ঙ। “ইচ্ছাকৃত ছাঁটাই আতঙ্ক তৈরি করে মজুরী ছাড়া অতিরিক্ত কর্মঘন্টায় কাজ করানোর” অভিযোগ প্রমান করতে হবে। নতুবা এধরনের উক্তির সমুচিত জবাব দিতে আমরা বাধ্য হব। উল্লেখ্য যে আমাদের রপ্তানী যেখানে আশংকাজনক হারে কমে এসেছে (জানুয়ারী-নভেম্বর ২০২০ সময়ে পূর্বের বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানী প্রবৃদ্ধি -১৭.৬৪%), যেখানে লে-অফের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে, সেখানে আবার ছাঁটাইকে আতঙ্ক বলা হচ্ছে। অতিরিক্ত কর্মঘন্টায় কাজ করানোর কথা বলা হচ্ছে যা লে-অফের সম্পূর্ণ বিপরীত। যেখানে রপ্তানী কমছে, লে-অফ হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে সেখানে অতিরিক্ত কর্মঘন্টার justification কি হতে পারে?
চ। “লে-অফের কারনে ১ বছরের কম সময় কর্মরত শ্রমিকরা কোন সুবিধা ছাড়াই চাকুরী হারায়” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, বিষয়টি কি অবৈধ বা বে-আইনি? যদি না হয়, তবে সেটি সুশাসনের লঙ্ঘন কিভাবে হয়? আর টিআইবি যদি আইনের সংস্কার চায় সেটি তাদের অধিকার, তবে যতক্ষন পর্যন্ত আইন যে অবস্থায় আছে সেটিকে অপশাসন আখ্যা দেয়া চরম ধৃষ্টতা।
শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতি আমাদের সহমর্মিতার চাইতে টিআইবি’র সহমর্মিতা বেশি হতে পারে না। তবে শ্রমিকদের বিষয়টি তাঁরা যেমন বুঝছেন, এই শিল্পে যেসকল উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করে ব্যর্থ হয়েছেন, সর্বস্ব হারিয়ে নিঃশেষ হয়েছেন, তাঁদেরও যে অধিকার আছে সে বিষয়টি টিআইবিকে কখনও বলতে শোনা যায়নি। তাহলে কি উদ্যোক্তা শ্রেনী টিআইবি’র সংজ্ঞায়িত মানবাধিকারের আওতা বহির্ভূত? আমরা এই প্রশ্নটি উত্তরের অপেক্ষায় থাকব।
৪। বেতন-ভাতা প্রদান সংক্রান্তঃ
প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে যে-
ক। “প্রায় ১৪ লক্ষ শ্রমিক বেতন ভাতা বাবদ সরকারী প্রণোদনার অর্থ পায়নি” বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এত ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিক বেতন-ভাতা না পেলে কি ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়, যেটি আমরা হতে দেখিনি। Microfinance Opportunities (MFO) এবং SANEM পরিচালিত ১৩০০ পোশাক শ্রমিকের উপর জরিপের তথ্য অনুযায়ী মার্চ-জুলাই সময়ে তাদের পূর্ণ বেতন পেয়েছেন (এপ্রিল ব্যতিরেকে যখন ৬৫% মজুরী দেয়া হয়েছিল)। আবার জুন-জুলাই ২০২০ সময়ে পরিচালিত Center for Bangladesh Studies, UC Berkeley, ও BRAC বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ৮৭% শ্রমিক বলেছেন যে তারা সময়মত তাদের মজুরী পেয়েছেন মোট ১,০৩৮ জন শ্রমিকের উপর জরিপ পরিচালিত হয়েছে)।
আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি বিজিএমইএ’র সদস্যভূক্ত সকল কারখানার শ্রমিকরা সরকারি প্রণোদনায় মজুরী প্রদানের সময়কালে বিধিবদ্ধভাবে মজুরী প্রদান করেছে। মার্চ মাসে ৪৬টি কারখানা সুনির্দিষ্টভাবে মজুরী প্রদানে ব্যার্থ হয় এবং অনেক চেষ্টার পরও তারা বেতন-ভাতা প্রদান না করলে বিষয়টি আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে মাননীয় শ্রম প্রতিমন্ত্রীকে কারখানার তালিকাসহ অবহিত করি।
খ। “৩,০০০ সবা-কন্ট্রাক্ট কারখানায় নিয়োজিত প্রায় ১৫ লক্ষ শ্রমিকের বেতন-ভাতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কবে নাগাদ এই অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, ঠিক কত শ্রমিক বেতন-ভাতা পাননি, এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি কি – এ সকল বিষয় উল্লেখ না করে আস্পষ্টভাবে একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে গুরুতর অপবাদ দেয়া হয়েছে। যেখানে একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে যে সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানার সংখ্যা কমে এসেছে, বিশেষ করে Mapped in Bangladesh এর জরিপে প্রাপ্ত মোট ৩২২৩টি পোশাক কারখানার মধ্যে মাত্র ৫৭৪টি কারখানা বিজিএমইএ/ বিকেএমইএ’র সদস্যবিহীন এবং যেগুলোকে মূলতঃ সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানা বলে আখ্যা দেয়া হয়। সেখানে ৩,০০০ সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানার তথ্য অগ্রহণযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে ৩,০০০ সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানার তথ্যটি নিশ্চিত করা এবং এগুলো কোন্ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে আছে সেটি খুঁজে বের করা উচিত। আমরা টিআইবি’র কাছে এসকল তথ্যের বিশদ ব্যাখ্যা ও হালনাগাদ তথ্য আশা করছি।
গ। মজুরী ও ঈদ বোনাসের ক্ষেত্রে ৩০%-৪০% ওয়েজ গ্যাপের কথা উল্রেখ করা হয়েছে, তবে বিষয়টি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করে একটি নেতিবাচক পয়েন্ট আকারে প্রতিবেদনে জুড়ে দেয়া হয়েছে মাত্র।
৫। চীন থেকে সরে আসা বাজারঃ
প্রতিবেদনের ১৩নং পাতায় বলা হয়েছে যে “এখাতের নেতৃবৃন্দ করোনা মহামারির কারনে চীন থেকে তৈরী পোশাক ব্যবসার একটি বড় অংশ বাংলাদেশে চলে আসবে এমন আত্মতুষ্টিতে ভোগে”, এবিষয় আমাদের ব্যাখ্যা হলঃ
ক। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে যখন চীনের পোশাক পন্যে সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ২০% অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হল, তখন অনেকেই বলেছিল যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পোশাকের নতুন সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে। তবে বিজিএমইএ থেকে আমরা তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখিয়েছিলাম যে এরকম আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই কারণ যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের প্রধান ৩০টি রপ্তানী পন্যের মধ্যে ১৬টিই চীন কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানী করা হয়, যা উভয় দেশের ক্ষেত্রেই কমে আসছে।
খ। চীন থেকে যেকোন কারনে বাজার সরে আসলে যদি বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয় সেটিকে নেতিবাচকভাবে দেখার যৌক্তিকতা বোধগম্য হচ্ছে না। আমরা দীর্ঘদিন যাবত চীন+১ এর সমীকরণটি শুনে অভ্যস্ত। এটি নতুন কোন বিষয় নয়, তাই নতুনকরে আত্মতুষ্টির অভিযোগ নিতান্তই মুর্খতা।
৬। ১১ বিলিয়ন ডলারের নতুন কার্যাদেশঃ
প্রতিবেদনের ১৩নং পাতায় ১১ বিলিয়ন ডলারের নতুন কার্যাদেশের উল্লেখ করা হয়েছে। নতুন কার্যাদেশ অবশ্যই আসবে এবং আমরা গত অর্থবছরে ২৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানী করেছি নতুন কার্যাদেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই। তবে এই ১১ বিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ কোন সময়কালের জন্য পাওয়া গেছে, তবে প্রতি মাসে রপ্তানী কমছে কেন, ব্যবসা পুনরায় শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে যে আত্মতুষ্টি থেকে সেটি কি রপ্তানীতে দৃশ্যমান, নাকি পোশাকখাতে সরকারের দেয়া সহায়তাকে নিরুৎসাহিত করার দূরভিসন্ধি থেকে বিভ্রান্তিকরভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে? ২৭নং পৃষ্ঠায় “সার্বিক পর্যবেক্ষনের” শুরুতেই তারা পোশাকখাতে প্রদত্ত প্রণোদনার উপর বিষদগার করেছন, এ ধরনের মন্তব্য আসলে টিআইবি’র শিল্প বিরোধী মনোভাবের পরিচয় দেয়।
৭। প্রণোদনার হার ও পরিমানঃ
প্রতিবেদনের ১৭নং পাতায় পোশাকখাতে প্রণোদনার হার ও পরিমানের তথ্য দেয়া হয়েছে। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী কর্তৃক সহায়তাকে প্রণোদনা আখ্যা দেয়ার অভিনব প্রয়াস আমাদের স্তম্ভিত করে। এখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানী কর্তৃক প্রদত্ত ৮৭৫ কোটি টাকার হিসাবটিও আনা হয়েছে, যদিওবা এটি এখনও পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি।
মূলতঃ যেভাবে সম্ভব শিল্পকে হেয় করার একটি সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা এই গবেষণা প্রতিবেদন, যেখানে ঋণের টাকাকে প্রণোদনা বলা হচ্ছে, শ্রমিক ও মালিকের প্রণোদনা যে এক নয়, শ্রমিকের বেতন ও মালিকের ঋণ যে এক নয়, এই দুয়ের মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য আছে, অতএব শিল্প ও শ্রমিকের প্রাপ্ত প্রনোদনার তুলনাটি যে ‘apple to apple’ নয় সেটি টিআইবি’কে বুঝতে হবে।
আবার ১% নগদ সহায়তা বাবদ ২,৮৯৫ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রণোদনাটি কোভিডের সাথে সম্পর্কিত নয়, তবে এটি এখানে কেন উল্লেখ হল তার কোন ব্যাখ্যা নেই। যদি সকল প্রণোদনার হিসাব উল্লেখ করতে হয় তাহলে অন্যান্য প্রণোদনার হিসাব নেই কেন? ২,৮৯৫ কোটি টাকার মধ্যে শিল্পকে কত টাকা প্রণোদনার অর্থছাড় ও প্রদান করা হয়েছে তার হিসাবটি কেন নেই? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো আমরা টিআইবি’র কাছ থেকে প্রত্যাশা কর্ িআংশিক তথ্য ও চিত্র দিয়ে মনগড়া প্রতিবেদন মেনে নেয়া যায় না।
৮। ইইউ ও জার্মানী’র ফান্ড বিতরনে অবহেলাঃ
ই’ইউ ও জার্মানীর ফান্ড ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের মধ্যে বিতরনে মালিক সংগঠনের অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ফান্ড গঠনের পেছনে বিজিএমইএ’র যে অগ্রগামী ভূমিকা ছিল টিআইবি হয়ত তা স্বীকার করবে না। বিজিএমইএ সর্বপ্রথম জার্মানীর মাননীয় মন্ত্রী গার্ড মুলারকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো অনুরোধ করেছিল। বিজিএমইএ বাংলাদেশস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতকে লেখা একাধিক পত্রের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে আহ্বান জানায়। আর এই ফান্ড বিতরনে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরামর্শকদের সাথে সভা করেছি, সকল শ্রমিকের তালিকা শেয়ার করেছি। শুধু তাই নয়, আমরা এ পর্যন্ত দুই’বার সাধারণ সদস্য বরাবর ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকা প্রদানের জন্য সার্কুলার প্রেরন করেছি। অতএব অবহেলার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
৯। স্বচ্ছতাঃ
প্রতিবেদনের ২১ নং পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, “সরকার ও মালিক পক্ষ কর্তৃক কল-কারখানার ধরন অনুযায়ী প্রাপ্ত প্রণোদনা ও সহায়তার পরিমান এবং প্রণোদনা/ সহায়তা প্রাপ্ত কারখানা ও শ্রমিকের তালিকা প্রকাশ করেনি।”বিষয়টি নিতান্তই অবান্তর এবং অগ্রহনযোগ্য। কারখানা স্ব স্ব শ্রমিকের তালিকা প্রয়োজনীয় তথ্যসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করেছে, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় তফসিলি ব্যাংকগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে শ্রমিকদের ব্যাংক একাউন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে সরাসরি বেতনের অর্থ প্রদান করে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট সকল তথ্য রয়েছে। টিআইবি’র নিকট কিংবা জনসমক্ষে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের কোন এখতিয়ার বিজিএমইএ’র নেই। বরং আমরা আশা করব টিআইবি নিয়মিতভাবে যেন তার আয়, আয়ের উৎস, ব্যয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্যান্য সকলের বেতন-ভাতা, সম্মানী, ইত্যাদি তথ্য বিশদ তালিকা আকারে জনসমক্ষে প্রকাশ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
আবার একই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে “বাতিল হওয়া প্রায় ৯০% কার্যাদেশ পুনর্বহাল হলেও বিজিএমইএ’র সে বিষয়ে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে বিরত রয়েছে”। এই অভিযোগটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, কারণ ৯০% কার্যাদেশ পুনর্বহালের তথ্যটি বিজিএমইএ’র যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উদ্ধৃত হয়েছে। এ বিষয়ে টিআইবি’র প্রেজেন্টেশনে “অভিযোগ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু এরকম কোন অভিযোগ আমাদের কেউ কখনও করেনি। এ বিষয়ে সংস্থাটির ব্যাখা আশা করছি।
১০। তথ্যের গড়মিলঃ
“সরকার কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যের সাথে বিজিএমইএ’র তথ্যের গড়মিল” এবং “ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ বাতিল সংক্রান্ত তথ্যের সাথে বিজিএমইএ’র তথ্যের গড়মিলের” কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে সরকারের সাথে আমাদের ঠিক কি কি ধরনের তথ্যের গড়মিল আছে তা বলা হয়নি। এমন কোন তথ্য সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই যা বিজিএমইএ ও সরকার উভয়ই আলাদাভাবে সংগ্রহ ও প্রকাশ করছে। আমরা ক্রয়াদেশ বাতিল ও শ্রমিকের মজুরী সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য অনলাইন পোর্টাল চালু করেছিলাম যেখানে প্রাপ্ত তথ্য মূলতঃ সদস্য প্রতিষ্ঠানসমূহ কর্তৃক পূরণ করা, এবং এই পোর্টালের লিংক ওয়ার্কাস রাইটস্ কনসোর্শিয়াম এর সাথেও শেয়ার করা হয়েছে, এবং বেশ কিছু গণমাধ্যমকে এই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন পক্ষের গড়মিল থাকলে তা পদ্ধতিগত কিংবা রিপোর্টিং এ ভিন্নতার কারনে হতে পারে। বিজিএমইএ তার প্রকাশিত সকল তথ্যের সততা শতভাগ নিশ্চিত করে।
১১। মানুষর জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে টিআইবি বলেছে পোশাকখাতে করোনার লক্ষণযুক্ত শ্রমিকের প্রাক্কলিত সংখ্যা ৩৪.২৮ লাখ। যেখানে ২০ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার, সেখানে এরকম একটি তথ্যকে শুধুমাত্র মনগড়া বলে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এর মাধ্যমে শ্রমখাতে ভিতি, আতঙ্ক ও নৈরাজ্য তৈরীর কোন পায়তারা চলছে কিনা তা তদন্ত করে দেখতে হবে।
১২। “ল্যাকটেটিং মাদার এইড ফান্ড প্রজেক্ট” বিগত প্রায় ১০ বছর যাবত চলমান একটি প্রকল্প। অতএব “এটি করোনার উদ্ভুত সংকটকালে গৃহীত একটি পদক্ষেপ” এই বিবৃতিটি সত্য নয়।
১৩। বিজিএমইএ স্বপ্রণোদিতভাবে ১টি পিসিআর ল্যাব স্থাপন করে এবং আরও ৩টি ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তবে এ বিষয়ে এমন কোন “অঙ্গীকার” করা হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই যেমনটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু পিসিআর ল্যাব স্থাপন একটি ব্যয়সাপেক্ষ বিষয় তাই পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে প্রয়োজন সাপেক্ষে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। একটি ব্যতিক্রমী বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে শ্রমিকদের জন্য পিসিআর ল্যাব স্থাপনের দৃষ্টান্তটি সাধুবাদ না জানিয়ে কি ধরনের সুশাসনের লঙ্ঘনের অভিযোগে এ বিষয়গুলো প্রতিবেদনে টেনে আনা হয় তা স্পষ্ট নয়। বরং এরকম অপপ্রচার ও হয়রানির ফলে অন্যান্য সেক্টর এধরনের পদক্ষেপ নিতে নিরুৎসাহিত হবে বলে আমরা মনে করি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বিগত ১৩ই মে ২০১৯ইং তারিখে বিজিএমইএ’র আমন্ত্রণে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল আমাদের সাথে দেখা করেন, যেখানে উভয় সংগঠন পোশাকখাতের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে একমত হয়, বিশেষ করে টিআইবি পোশাকখাতকে ঘিরে বিশদ একটি গবেষণা (Comprehensive Study) পরিচালনার ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু প্রায় ১.৫ বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোন আগ্রহ দেখা যায়নি, বিষয়টি নিয়ে বিজিএমইএ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোন ফল হয়নি।
১৪। গবেষণাটিতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতকরণ ও উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করে অংশীজনদের করনীয় নির্ধারণ’কে মূল উদ্দেশ্য বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে আছে শ্রমিক ও শ্রম সংক্রান্ত বিষয়সমূহ। প্রত্যক্ষ তথ্যের উৎসের মধ্যে অন্যান্যদের পাশাপাশি শ্রমিক ফেডারেশন নেতৃবৃন্দও রয়েছেন। তবে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা ও উত্তরণে যেসকল অংশীজনের করনীয় নির্ধারণের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে তার মধ্যে সরকার, মালিক ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান থাকলেও শ্রমিক প্রতিনিধিদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। করোনকালীন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও মানসিক-শারিরিক সু-স্বাস্থ্যের বিষয়ে শ্রমিক প্রতিনিধি/ ফেডারেশন নেতৃবৃন্দের ভূমিকাকে গৌণ করে দেখা হয়েছে, যা শোভনীয় নয়। বরং টিআইবি’র মত অন্যান্য Social Partner দেরও এই প্রচেষ্টার সাথে সম্পৃক্ত করা উচিত। শুধুমাত্র নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক প্রবন্ধ রচনা নয়, এসকল সংগঠন সুশাসন নিশ্চিতের লক্ষ্যে নিজেদের কিভাবে Proactively সম্পৃক্ত করতে পারে সেটি খুঁজে বের করা উচিত।
পরিশেষঃ
টিআইবি’র এই আলোচ্য গবেষণা প্রতিবেদনটি –
এটি পূর্ণাঙ্গভাবেই একটি এলোমেলো প্রতিবেদন, যেখানে একদিকে বলা হচ্ছে লে-অফ/ ছাঁটাই হচ্ছে, অন্যদিকে বলা হচ্ছে অতিরিক্ত কর্মঘন্টায় শ্রমিকদের খাটিয়ে নেয়া হচ্ছে, আবার ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের ফলে পোশাক শিল্পে নগদ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, শ্রমিকদের কর্মহীন হয়ে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, অপরদিকে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেয়া সুরক্ষা প্যাকেজের ঘোর বিরোধিতা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনটি বিচ্ছিন্নভাবে সংগ্রহ করা তথ্যের কিছু মনগড়া সংকলন (compilation) যার কোন মৌলিক দিক কিংবা মূল্য সংযোজন নেই, বরং শিল্প বিরোধী একপেশে অবস্থান থেকে অলীক ও অবাস্তব ব্যাখ্যার মাধ্যমে শিল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা।
বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে আমরা প্রতিবেদনটি প্রত্যাখান করছি এবং প্রত্যাশা করছি তারা এই প্রতিবেদনটি পুনঃমূল্যায়ন ও সংস্কার করবেন। সেই সাথে আমরা টিআইবি’র প্রতি নিম্নোক্ত কিছু সুপারিশ তাঁদের সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছিঃ
১। সুশাসন ও অপশাসন/ দুঃশাসনের সংজ্ঞা ও মৌলিক ভিন্নতাগুলো নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী সমালোচনা করা।
২। গবেষণায় Ethics ও নীতিমালার প্রতি আরও যত্নশীল হওয়া এবং প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে অংশীজনদের সাথে সংলাপ করা।
৩। Reactive গবেষণায় মনযোগী না হয়ে Proactive বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করা। এক্ষেত্রে গবেষণার সময় নির্বাচনে যত্নশীল হওয়া, কারণ প্রত্যেকটি বিষয়ের কিছু সমসাময়িক প্রেক্ষাপট ও স্পর্শকাতরতা থাকে যা এ ধরনের বিলম্বিত গবেষণায় অনুধাবিত হয় না।
৪। টিআইবি’র আভ্যন্তরীণ বিষয়ে স্বাচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, জনসমক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ এবং গবেষণা কার্যে নিয়োজিত সদস্যদের গবেষণা পদ্ধতি ও শুদ্ধাচারের উপর প্রশিক্ষণ প্রদান এবং এ সংক্রান্ত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা।
৫। মানবতা সমুন্নত রেখে বাস্তবতার নিরিখে শিল্প, অর্থনীতি ও দেশকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে যেকোন প্রকার সংকীর্ণতা উপেক্ষা করা।